Saturday, July 13, 2024

চলুন একটি খেলা খেলি। আপনাকে একটা খাম দিলাম। খুলে দেখলেন, এতে ২০ টাকা আছে। আর এদিকে আমার হাতে আছে আরেকটি খাম। আপনাকে জানালাম, আমার হাতের খামে হয় ১০ বা ৪০ টাকা আছে। মানে আপনার খামের টাকার অর্ধেক বা দ্বিগুণ। দুই পরিমাণের সম্ভাবনা সমান ৫০% করে। আপনাকে দুটো অপশন দিলাম।


খাম প্যাারাডক্স


১। ২০ টাকার খামটি রাখুন অথবা

২। আগের খান ফেরত দিয়ে আমার কাছে থাকা খামটা নিন


আপনি কী করবেন? অনেকেই হয়ত অতশত ভাবনায় না গিয়ে ১ম খামটাই (২০ টাকার) রেখে দিতে চাইবেন। তবে একটু হিসাব করেই দেখি না! 


এ ধরনের হিসাব করতে কাজে লাগবে পরিসংখ্যান। কারণ এখানে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে দরকার হবে এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষার। তো করে ফেলি একটা সরল পরীক্ষা। ধরা যাক আমরা কাজটা করলাম ১০ বার। 


১। প্রত্যেকবার ২০ টাকার খামটাই রেখে দিলে মোট টাকা পাওয়া যাবে ২০ x ১০ = ২০০ টাকা।

২। খাম বদলে নিলে গড়ে ৫ বার ১০ টাকা আর ৫ বার ৪০ টাকা পাবেন (কারণ সম্ভাবনা সমান ৫০% করে)। তাহলে মোট পাবেন ১০ × ৫ + ৪০ × ৫ = ৫০ + ২০০ = ২৫০।


তাহলে দেখা গেল, পাল্টালে লাভ। দারুণ তো!


আরেকটা খেলা!


আমার হাতে আছে দুটো খাম। কোনটায় কত আছে তা আপনাকে জানাইনি। শুধু বললাম, একটায় আরেকটার দ্বিগুণ টাকা আছে। আপনাকে বললাম, ইচ্ছামতো একটা তুলে নিন। তবে আগের মতো ভেতরে কত আছে তা দেখা যাবে না। এবারও আপনাকে দুটো অপশন দিলাম৷ 


১। তোলা খামটা রেখে দিন। বা

২। অপর খামটা নিন, যাতে অর্ধেক বা দ্বিগুণ টাকা আছে।


আপনি কি খামটা পাল্টাবেন?


হিসাবে কী আসে দেখি!


ধরুন তোলা খামটায় 'ক' টাকা আছে। তাহলে অপর খামে আছে হয় ক/২ বা ২ক টাকা। দুটো পরিমাণেরই সম্ভাবনা সমান ৫০%।


আগের মতো ১০ বার কাজটা করলে কী হয় দেখি।


১। না পাল্টালে পাবেন ক × ১০ = ১০ক টাকা

২। পাল্টালে পাবেন ২ক × ৫ + ক/২ × ৫ = ১০ক + ৫ক/২ = ১২.৫ ক,  যা ১০ক-এর চেয়ে বেশি। 


দ্বিতীয় অপশনে গড়ে বেশি আসে আগের মতোই। তাহলে পাল্টালে লাভ!


গাণিতিক বুদ্ধির সদ্ধ্যবহার করে আপনি পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আপনার হাতে এখন দ্বিতীয় খামটি। 

এবার আমি আপনাকে আরেকটা অফার দিলাম।  আমি বললাম, খাম আরেকবার পাল্টাবেন? 


আপনি প্রথম খামটার দিকে তাকালেন। যা একটু আগেই আপনার কাছে ছিল। তাকালেন, অপর খামের দিকেও। কোনটায় কী আছে জানা নেই। তবে এটা পরিষ্কার, পাল্টালেই আপনি আগের মতোই অর্ধেক বা দ্বিগুন পাবেন। আগেই দেখেছি আমরা, পাল্টালে লাভ। অতএব, পাল্টান।


এতে করে ফিরে গেলেন আগের জায়গায়। এবারও খাম নেওয়ার আগে মনে পড়ল, পাল্টে নিলে লাভের সম্ভাবনা বেশি। তাই, আবার পাল্টালেন। আবার, আবার, আবার...


শেষমেশ দেখা গেল, টাকা পাওয়ার বদলে আপনি বাকি জীবন খাম পাল্টাতে পাল্টাতে সময় পার করবেন। 

Category: articles

Monday, October 16, 2017

লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন

আচ্ছা, আপনি কি এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়েই বলে দিতে পারেন সেখানে আগে চা ঢেলে পরে দুধ মেশানো হয়েছে না আগে দুধ ঢেলে পরে কেতলি থেকে ঢালা হয়েছে চা? খুব কঠিন একটি ব্যাপার নিঃসন্দেহে। অথচ এমন দক্ষতা আছে- এই দাবি করে জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছেন একজন মহিলা। না, এটা তাঁর দক্ষতার গুণে নয়, তাঁর এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে পরিসংখ্যানের অন্যতম প্রধান একটি শাখা- পরীক্ষণ নকশা (design of experiments)।


১৯১৯ সালের কথা। পরিসংখ্যানের জনক বলে খ্যাত স্যার রোনাল্ড ফিশার তখন গবেষণা করছেন রথামস্টেড গবেষণা কেন্দ্রে। একদিন সকালে চা খাচ্ছেন এমন সময় সেখানে হাজির হল এক তরুণী। নাম তার মুরিয়েল ব্রিস্টল। মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি করছে। ফিশারকে চা খেতে দেখেই সে বলে উঠল আমি কিন্তু চায়ে চুমুক দিয়েই বলে দিতে পারি কাপে আগে চা ঢেলে পরে দুধ মেশানো হয়েছে না আগে দুধ ঢেলে পরে চা ঢালা হয়েছে।

ফিশার তখনই কিছু বললেন না, কিন্তু বিষয়টা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। মেয়েটির সত্যিই কি এমন দক্ষতা রয়েছে না এটা শুধু বাত কি বাত। তিনি মেয়েটিকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কীভাবে পরীক্ষা করা হবে? এর জন্য চাই একটি ছক বা নকশা। তিনি ৮ কাপ চা বানালেন। ৪ কাপে আগে ঢাললেন দুধ আর বাকি ৪ কাপে আগে ঢাললেন চা। এবার তিনি কাপগুলো এলোমেলো করে সাজালেন যাতে মুরিয়েল বুঝে উঠতে না পারে কোন কাপ চা কীভাবে বানানো হয়েছে। এই এলোমেলো করে সাজানো কাপ থেকেই দৈবায়ন (randomness) এর ধারণাটি এসেছিল।

পরিসংখ্যানবিদ রোনাল্ড ফিশার। ১৯৩১ সালের ছবি। সূত্রঃ ম্যাথব্লগ ডট অর্গ

তো, মুরিয়েলকে বলা হলো, মুরিয়েল সেখান থেকে ৪ কাপ চা পান করবে এবং বলবে কোন কাপ চা কীভাবে বানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল কত কাপ চা সঠিকভাবে বানানো হয়েছে বলতে পারলে ফিশার মুরিয়েলের দাবি মেনে নেবেন? ৪ কাপই সঠিক বলতে পারলে তো কোনো কথাই নেই, কিন্ত এর থেকে কম হলেও ফিশার তা মেনে নেবেন কেননা তিনি যে পরীক্ষণটিকে সেভাবেই সাজিয়েছেন। ৮ কাপ চা থেকে ৭০ ভাবে ৪ কাপ চা চয়ন করা যায়। আর প্রতি ক্ষেত্রেই মুরিয়েলের উত্তর হয় সঠিক হবে অথবা ভুল হবে। অর্থাৎ এখানে দুটি মাত্র সম্ভাবনা আছে। মুরিয়েলের উত্তর ৪টিই ভুল হতে পারে, হতে পারে ১টি ঠিক ৩টি ভুল, ২টি ঠিক ২টি ভুল, ৩টি ঠিক ১টি ভুল, অথবা ৪টিই সঠিক।

পরিসংখ্যানের ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু এর মাঝেই একটি বিষয় ধরে ফেলেছেন। আর তা হল মুরিয়েলের উত্তরকে একটি দ্বিপদী নিবেশনে (binomial distribution) বিন্যস্ত করা যায়। সেই সাথে এই কথাটিও বলে রাখা দরকার যে এর আগে পরিসংখ্যানে পরিমিত নিবেশনের ব্যবহার হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে কাই-বর্গ, স্টুডেন্টের t, কিন্তু ফিশারই প্রথম পরিসংখ্যানে দ্বিপদী নিবেশনের ব্যবহার ঘটালেন এমন মজার এক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে।

মুরিয়েলের সম্ভাব্য উত্তরগুলির বিন্যাস কেমন হতে পারে তা সাজালেন ফিশার নীচের এই ছক অনুসারে।
[দ্রঃ × = উত্তর ভুল হয়েছে এবং √ = উত্তর সঠিক হয়েছে] 

সঠিক উত্তরের সংখ্যা বিন্যাসের ধরন ঘটন সংখ্যা
×××× ১×১ = ১
×××√, ××√×, ×√××, √×××, ... ৪×৪ = ১৬
××√√, ×√×√, ×√√×, √×√×, √√××, √××√, ... ৬×৬ = ৩৬
×√√√, √×√√, √√×√, √√√×, ... ৪×৪ = ১৬
√√√√ ১×১ = ১
মোট ৭০

সাধারণভাবে আমরা কোনো সম্ভাবনা ৫% এর নীচে নেমে গেলে তা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করি। এখানে অন্তত ১ কাপ চা সঠিকভাবে বলতে পারার সম্ভাবনাই (১৭/৭০=) ২৪.৩%। তাই ফিশার মুরিয়েলকে বললেন যে সে যদি এক কাপ চায়ের কথাও সঠিকভাবে বলতে পারে তবে তিনি মুরিয়েলের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা মেনে নেবেন। বাস্তবে যা হয়েছিল তা হল মুরিয়েল শুধু যে নির্বাচিত ৪ কাপের কথাই সঠিকভাবে বলেছিল তাই নয়, সে একে একে ৮ কাপ চা-ই পান করেছিল এবং তার সবগুলো উত্তরই ছিল সঠিক। অবিশ্বাস্য!

ড. মুরিয়েল ব্রিস্টল কীভাবে এই অদ্ভুত ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তা নিয়ে অনেকের কৌতূহল থাকলেও শেষ অবধি এই ঘটনা পরিসংখ্যানের জগতে এক মাইলফলক হয়ে রইল। পরিসংখ্যানের রত্নভান্ডারে যুক্ত হল পরীক্ষণ নকশার মত এক মাণিক্যের।

[লেখক: অধ্যাপক, গাণিতিক বিজ্ঞান বিভাগ, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র] 
Category: articles

Friday, September 22, 2017

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। সংখ্যা পদ্ধতির যদিও অনেকগুলো নিয়ম আছে তবু আমরা সাধারণত ব্যবহার করি দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি (Decimal Number System)। এ ধরনের পদ্ধতিতে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত মোট দশটি সংখ্যা থাকে। হায়! হায়! প্রশ্নই করতে ভুলে গেলাম। প্রশ্ন হল, দৈব পদ্ধতিতে (at random) যে কোনো অঙ্কের (digit) যে কোনো একটি সংখ্যা নিলে সেই সংখ্যাটি ১ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনা (Probability) কত? অথবা ৩ দিয়ে বা ৬ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনাই বা কত?

নিশ্চয় ভাবছেন, এ তো ভারি সোজা কাজ। দশমিক পদ্ধতিতে অঙ্ক আছে ১০ টি। এর মধ্যে ০ দিয়েতো আর কোনো সংখ্যা শুরু হতে পারে না। তাই, সব সংখ্যাই ১ থেকে ৯ -এই অঙ্কগুলোর কোনো একটি দিয়েই শুরু হবে। অতএব, কোনো একটি সংখ্যা ১ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনা ৯ এর মধ্যে ১। সম্ভাবনার ভাষায় $\frac{১}{৯}$ বা প্রায় ১১ শতাংশ। একই সম্ভাবনা প্রযোজ্য হওয়া উচিত ৩, ৬ বা অন্য যে কোন অঙ্কের জন্যেই। বড় অঙ্ক হলেই যে তার অধীনে বেশি সংখ্যা থাকবে- সম্ভাবনা তত্ত্ব অন্তত এমনটি বলে না!

তবে উল্টোটা কিন্তু বলে। সেটা কেমন?
বাস্তবে দেখা যায় ছোট অঙ্কের অধীনেই বেশি সংখ্যার অস্তিত্ত্ব। দৈবভাবে কোনো একটি সংখ্যা নিলে সেটি ১ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। ২ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনা আরেকটু কম। ক্রমান্বয়ে সম্ভাবনা কমে যায় বড় অঙ্কের ক্ষেত্রে। তাও আবার একটি প্যাটার্নও মেনে চলে এই ঘটনাটি।বাস্তব পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলালে দেখা যায়, ৯ অংকটি দিয়ে শুরু হওয়া সংখ্যার পরিমাণ ১১ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। অথচ আমরা সম্ভাবনা তত্ত্ব খাটিয়ে শুরুতে সবার জন্যেই ১১ শতাংশ নির্ধারণ করেছিলাম। ৮ দিয়ে শুরু হয় আরেকটু বেশি সংখ্যক সংখ্যা। অন্য দিকে ১ এর দখলে রয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যা! সবচেয়ে বেশি।

এতক্ষণ বলেছিলাম, দৈবভাবে কোনো সংখ্যা নিলে তার সম্ভাবনা এই রকম স্বধর্মচ্যুতি প্রদর্শন করে। কিন্তু, ব্যাপারটি শুধু দৈব বা র‍্যান্ডম ডেটার জন্যেই যে প্রযোজ্য তা নয়। বাস্তব জীবনের বিভিন্ন হিসাব নিকাশ যেমন বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের জনসংখ্যার কথা বলুন অথবা শেয়ার মার্কেট বা নদীর দৈর্ঘ্যের কথাই বলুন- সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় ১ এর জয়জয়কার।

পদার্থিবিজ্ঞানী হয়েও কোন গণিতবিদ বা পরিসংখ্যানবিদের হাতে আবিষ্কার হবার আগেই ফ্র্যাংক বেনফোর্ড এই নিয়মটি আবিষ্কার করে ফেলেন। সালটি ছিল ১৯৩৮। তিনি দেখলেন, বড় অঙ্কদের ক্ষেত্রে সংখ্যার পরিমাণ উল্লখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। সংখ্যার শুরুতে ১ এর আগমণ ঘটে ৩০.১ শতাংশ বার। ২ এর আবির্ভাব ঘটে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ বার। ৩ এর ক্ষত্রে এটা ঘটে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বার। এভাবে চলতে চলতে ৯ এর ভাগে পড়ে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ সংখ্যা।

বেনফোর্ডের নীতি। বিভিন্ন অঙ্কের ঘটনসংখ্যা 

এটা কেন ঘটে? এটাকি প্রকৃতির ভারসাম্যের বিপরীত কোন কিছু। না, তা হতেই পারে না। এমন ঘটনা ঘটার পেছনেও রয়েছে খোদ গাণিতিক কারণ। আসুন ডুব দেই সেই গণিতে। মনে করুন, আমরা কোনো কারণে লটারি করব। প্রতিযোগী ৯ জন হলে আমরা ১ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্ক লিখে ৯ খানা টোকেন বানাবো। এই অবস্থায় যে কোনো টোকেনধারীর বিজয়ী হবার সম্ভাবনা সমান। $\frac{১}{৯}$  বা ১১ দশমিক ১ শতাংশ।

এবার ধরা যাক, শেষ মুহূর্তে আরেকজন প্রতিযোগী যুক্ত হলেন। মানে ১০ জন হলেন। তাহলে এবার!
১ অঙ্কটি দিয়ে টোকেন নাম্বার শুরু হবে- এমন হবার সম্ভাবনা এক লাফে উঠে গেছে ১৮ দশমিক ২ পার্সেন্টে। কারণ ১০টি টোকেনের ২ খানাই ১ দিয়ে শুরু। বাড়তে বাড়তে প্রতিযোগী যদি ১১ থেকে ক্রমেই ১৯ জন হয়ে যান, ১ এর কপালও যেন অদৃশ্য ডার্ক এনার্জির প্রভাবে চওড়া হয়ে যায়। ১৯ টোকেনের ক্ষেত্রে এটা দাঁড়াবে ৫৮ শতাংশ।

এবার ২ এর সুযোগ নেবার পালা। যখনি আমরা ২০ নম্বর টোকেন যুক্ত করলাম ২ এর সম্ভাবনা বেড়ে গেল এবং ১ এর সম্ভাবনা একটুখানি কমে গেল। ২৯ পর্যন্ত যেতে যেতে ২ অনেকখানি বাড়ল এবং ১ এর আধিপত্য কমতে কমতে ২ এর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হলো।

টোকেনের প্রথম অঙ্ক তিনে পা দিতে ময়দানে উথান ঘটল তৃতীয় শক্তির! ১, ২ ও ৩ আধিপত্য ভাগাভাগি করে নিল। এভাবে আস্তে আস্তে সবাই নিজের জায়গা দখল করল। কিন্তু ১ একটু বেশিই বুদ্ধিমান। সে যখন নিজের বিপদ বুঝতে পারলো, আবার নতুন চাল চেলে পদার্পণ করলো তিন অঙ্কের জগতে। আবারো বাড়িয়ে ফেললো নিজের সম্ভাবনা। দেখাদেখি, অন্যরাও তাই করতে শুরু করলো। কিন্তু অন্যরা কাছাকাছি আসলেই ১ প্রবেশ করে নতুন অঙ্কের জগতে, সবার আগে আগে।

ফলে, আমরা যখন অনেক বেশি সংখ্যা হিসেব করবো, তখন ১ অন্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকে। যেমন, ১ চার অঙ্কের ঘরে প্রবেশ করলে অন্যদের সেখানে আসতে আরো ১ হাজার করে সংখ্যার নদী পাড়ি দিতে হয়। ১ লক্ষের ঘরে, কোটি বা বিলিয়ন, কোয়াড্রলিয়নের ঘরে প্রবেশ করলে অন্যদের সেখানে আসতে কতো সময় লাগে, চিন্তার ভার আপনার।

কয়েকটি ক্ষেত্রে বেনফোর্ডের নীতিটি প্রযোজ্য নয়। যেমন মানুষের উচ্চতা বা ওজোনের ক্ষেত্রে। অর্থ্যাৎ, মূলত যেসব ক্ষেত্রে মানের নির্দিষ্ট সীমা থাকবে তাতে এই নিয়ম ফল দেবে না। এছাড়াও কাজ হবে না দুই অঙ্কের সংখ্যার ক্ষেত্রেও। জানেনইতো,  সম্ভাব্যতার অন্যতম একটি  নিয়ম হচ্ছে যত বেশি নমুনা (Sample) নেওয়া হবে, প্রকৃত সম্ভাবনা প্রত্যাশিত সম্ভাবনার ততো কাছকাছি আসবে।এটাও মেনে চলে সেই নিয়ম।

কিন্তু, আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই নিয়মটি খাটে ভালোমতোই। ফলে ডেটায় ভুল বের করতে এই নীতিটিও কাজে লাগানো হয়। নিয়মের সাথে গরমিল হলেই বোঝা যায় এটা প্রকৃত উপাত্ত নয়। বরং কেউ বানিয়ে নিয়েছে। অন্য আরও অনেক কিছুর সাথে সাথে এই নিয়মটি আরও  প্রযোজ্য বিদ্যুৎ বিল, রাস্তা নম্বর, মৃত্যু হার এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক ধ্রুবকের ক্ষেত্রেও।

আরেকটি কথা, এই সূত্রটি যে শুধু দশ ভিত্তিক তথা দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির জন্যেই সীমাবদ্ধ- এমন কোন কথা নেই। এটি ১৬ ভিত্তিক হেক্সাডেসিমাল সংখ্যার ক্ষেত্রেও ভালো খাটে।
২৩৭ টি দেশের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্কগুলোর শতাংশের হিসাবে দখল। কালো বিন্দুগুলো দ্বারা বোঝানো হচ্ছে বেনফোর্ড নীতির পূর্বানুমান (Prediction)। দুটোর পার্থক্য পরিসংখ্যানের স্বাভাবিক একটি রীতি। 

সূত্র:

[১] লিস্টভার্স
[২] উইকিপিডিয়া
Category: articles
লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন
(লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

জুয়া পৃথিবীর আদিমতম খেলা। যদিও প্রায় প্রতিটি ধর্মেই জুয়া খেলাকে পাপ বলা হয়েছে তারপরেও এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। ক্রিকেটের নামে আইপিএল বা বিপিএল-এ যা হচ্ছে এটা জুয়া ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশের পান সিগারেটের দোকানে পর্যন্ত বেটিং এর কার্ড পাওয়া যাচ্ছে- ভাবাই যায় না।

যে সময়ের কথা বলছি সেটা সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝি। সমগ্র বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপে জুয়া তখন অভিজাতদের খেলা। পোলোর মত বেশ কিছু খেলা রাজাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমনকি যে ক্রিকেট আজ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের খেলায় পরিণত হয়েছে একসময় তা ছিল শুধুই লর্ডদের খেলা, সাধারণ মানুষের এই খেলায় অংশ নেয়া তো দূরের কথা, খেলার মাঠে দর্শক হিসেবেও প্রবেশাধিকার ছিল না। কোনো কোনো জুয়াতে তো মাথাই কাটা পড়ত বিজিতের। আর খেলা যেহেতু রাজ রাজাড়াদের সেখানে পুরষ্কারের মূল্যও ছিল অনেক বেশি। পুরষ্কার হিসেবে থাকত রাজ্য, মূল্যবান মণি মানিক্য, এমনকি রাণীও। যে রাজার শতাধিক রাণী আছে তিনি দু চারজন রাণীর ওপর বাজি ধরবেন এতে আর অবাক কী? ইউরোপে জুয়ার তীর্থস্থান ছিল মন্টি কার্লো। এখন যেমন লাস ভেগাস তখন ছিল মন্টি কার্লো। সেখানে খেলা ছিল জুয়াড়িদের পরম আরাধ্য। আর কত নতুন খেলার উৎপত্তিই না হয়েছে এই শহরে। আর এভাবে একদিন জুয়া খেলা থেকেই উদ্ভব হল সম্ভাবনা তত্ত্বের, যাকে আমরা বলে থাকি পরিসংখ্যানের হৃৎপিণ্ড।


তো সে সময়ের এক খেলাকে কেন্দ্র করে বাঁধল বিপত্তি। দু’জন খেলোয়াড় খেলছে একে অপরের বিরুদ্ধে। যিনি প্রথম ৪ টি ম্যাচ জিতবেন তিনি হবেন এই খেলায় বিজয়ী। খেলায় কোন ড্র এর সুযোগ নেই, ড্র হলে টাইব্রেক করে ম্যাচের নিষ্পত্তি হবে। আর যিনি বিজয়ী হবেন পুরষ্কারের পুরো অর্থই পাবেন তিনি। সে আমলে এটাই ছিল রীতি। এখন যেমন বিজয়ী ও বিজিত উভয় দলের জন্যই আছে প্রাইজমানি, চ্যাম্পিয়নের পাশাপাশি রানার আপও পুরষ্কার পান, তখন এসবের বালাই ছিল না। লুজার ইজ এ লুজার। খেলায় হেরেছিস আবার টাকা চাস, লজ্জা নেই তোর?

আবার খেলায় ফিরে আসি। ধরা যাক খেলোয়াড় দুজনের নাম A এবং B। A জিতেছে ১ম, ২য় ও ৪র্থ ম্যাচ আর B জিতেছে ৩য় ম্যাচ। অর্থাৎ A যখন ৩-১ এ এগিয়ে আছে তখন অনিবার্য কারণ বশত খেলাটি পরিত্যক্ত হল। যেহেতু খেলায় কেউ বিজয়ী হয়নি আয়োজকেরা পুরষ্কারের অর্থ দুই খেলোয়াড়ের মাঝে ভাগ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক্ষেত্রে ন্যায্য ভাগাভাগিটা কেমন হবে? যেহেতু A ৩-১ এগিয়ে আছেন তাই আয়োজকেরা এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কারের মোট অর্থ ৪ ভাগ করে A কে ৩ ভাগ আর B কে ১ ভাগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। গণিতের আনুপাতিক নিয়ম অনুসারে এটাই ন্যায্য ভাগ।

B এই ভাগ মেনে নিলেন, কিন্তু আপত্তি জানালেন A। যদিও তিনি খেলায় বিজয়ী হননি, আর ১ টা ম্যাচ জিতলেই তিনি হয়ে যেতেন পুরো টাকার মালিক। তিনি যেন বিজয়ের একটা গন্ধ পেতে শুরু করেছিলেন। তাঁর মন কিছুতেই এই ভাগাভাগি মানছিল না। গণিতের হিসাবে এই ভাগ ঠিক আছে, কিন্তু কোথায় কী যেন ঠিক নেই, তাঁর আরও বেশি পাওয়া উচিত। তিনি দ্বারস্থ হলেন আরেকজন বিখ্যাত জুয়াড়ি এবং সৌখিন গণিতবিদ শোভার ডি মিরির (Chevalier de Méré) কাছে। ডি মিরি প্রথমে এর কোনো গুরুত্ব দিলেন না। A চলে গেলেন প্রখ্যাত গণিতবিদ ব্লেইস প্যাসকাল (Blaise Pascal) এর কাছে। প্যাসকালও প্রথমে একে গুরুত্ব দিতে চাননি। ভাগ তো ঠিকই আছে- A ৪ খেলায় জিতেছে ৩ টা ম্যাচ, B জিতেছে ১টা। তাহলে চারভাগের ৩ ভাগ আর ১ ভাগ ঠিকই তো আছে।

কিন্তু A তবুও নাছোড়বান্দা। অতঃপর ডি মিরি, প্যাসকাল এবং আরও একজন প্রথিতযশা গণিতবিদ পিয়ের ডি ফারমা (Pierre de Fermat) বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন। তাঁরা যেভাবে এর সমাধান করেছিলেন তা একটু জটিল। সবার সহজে বোঝার জন্য এর একটা সরল পাঠ এখানে উপস্থাপন করছি।

আমরা জানি যে ৪ টা ম্যাচ হবার পর খেলাটি পরিত্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু যদি খেলাটি নির্বিঘ্নে চলতে পারত তাহলে কী হতে পারত এর ভবিষ্যত ফলাফল? দুইজন খেলোয়াড় খেলছে সর্বোচ্চ ৪ টি ম্যাচ জেতার জন্য এবং এখানে ড্রয়ের কোন সুযোগ নেই। একজন খেলোয়াড় যদি টানা ৪ ম্যাচ জেতে তাহলে ৪ ম্যাচ পরেই খেলা শেষ, কিন্তু এর অন্যথাও তো হতে পারে। তবে যাই হোক কোনভাবেই এই খেলা ৭ ম্যাচের বেশি গড়াবে না, কেননা ৭ ম্যাচ শেষে কেউ না কেউ অবশ্যই ৪ ম্যাচ জিতে যাবে এবং সেই হবে বিজয়ী। আলোচ্য খেলাটিতে ৪ টি ম্যাচ হয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ আর হতে পারত সর্বোচ্চ ৩ টি ম্যাচ।
এখন এক নজরে দেখে নেয়া যাক এই ৩ ম্যাচে কী কী ফলাফল হতে পারত এবং তাতে কার জেতার সম্ভাবনা ছিল কতটা? (টেবিল বুঝতে হলে মনে করে দেখুন, বলা হয়েছিল, ৩য় ম্যাচ B জিতেছিল। সেই হিসেবেই সাজানো হয়েছে।)

যা হতে পারত চূড়ান্ত ফলাফল বিজয়ী
AAA AABAA A
AAB AABAA A
ABA AABAA A
ABB AABAA A
BAA AABABA A
BAB AABABA A
BBA AABABBA A
BBB AABABBB B

৩ টি খেলায় ৮ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল আসতে পারত। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে প্রথম ৪ টি ফলাফলে ৫ম ম্যাচেই খেলা শেষ হয়ে যেত এবং A ৪-১ ব্যবধানে জয়লাভ করত। এর পরের ৩ টি ফলাফল বলছে খেলাটি চলত ৬ষ্ঠ ম্যাচ পর্যন্ত এবং তাতে A ৪-২ ব্যবধানে জিতে যেত। ৭ম ফলাফল বলছে খেলা গড়াতে পারত ৭ম ম্যাচ পর্যন্ত এবং এখানেও বিজয়ী হত A ৪-৩ ব্যবধানে। ৮ম ফলাফল বলছে খেলাটি ৭ম গেমেই নিষ্পত্তি হত এবং কেবলমাত্র এই খেলাতেই জয় ছিনিয়ে নিতে পারত B ৪-৩ এই ব্যবধানে।

যেহেতু ৮ টি সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে ৭ টিতে জয় পেত A আর ১ টিতে B, মোট অর্থের ৮ ভাগের ৭ ভাগ পাওয়া উচিৎ A এর, আর বাকি ১ ভাগ B এর। অর্থাৎ A আগে যেখানে ৭৫ ভাগ পেতেন এখন সেখানে পাচ্ছেন ৮৭.৫% অর্থ। এই নতুন বন্টনে B এর ভাগ কিন্তু অর্ধেক কমে গেল আর তা যুক্ত হল A এর ভাগের সাথে। পুরস্কার যখন মোটা অংকের তখন এই বাড়তি ভাগও বিশাল একটা ব্যাপার।

তা A আর B কে কত পেয়েছিল তা ইতিহাসের খাতায় জমা থাক, আমরা তো পেয়ে গেলাম এক বিশাল হীরকখনি- পরিসংখ্যানের হৃৎপিণ্ড সম্ভাবনাতত্ত্ব। সম্ভাবনার উৎপত্তিস্থল হিসেবে আলাদা মর্যাদা পেল মন্টিকার্লো। এই মুহূর্তে পরিসংখ্যানে সবচে বেশি ব্যবহৃত প্রতিরূপক (simulation) পদ্ধতির নামকরণ করা হয়েছে মন্টিকার্লোর নামেই। আর সম্ভাবনার ডানায় চেপে আমরা আজ বিচরণ করছি ভবিষ্যতের অজানা ভুবনে। সম্ভাবনাতত্ত্ব আজ পরিণত হয়েছে জ্ঞানবিজ্ঞানের টাইমমেশিনে।

লেখক: অধ্যাপক, গাণিতিক বিজ্ঞান বিভাগ, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
Category: articles

Saturday, September 16, 2017

লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন
(লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে ফেসবুক থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

এ জগতে কত রকম পিতাই তো আছেন। আপনি হতে পারেন সন্তানের জন্মদাতা পিতা, পালক পিতা, দত্তক পিতা, স্ত্রীর সন্তান সেই সূত্রে পিতা সাধারণ ভাষায় যাকে বলে সৎ পিতা। আবার যারা একটি জাতির মাঝে জাতিসত্ত্বার জন্ম দিয়ে থাকেন তাঁদের বলা হয় জাতির পিতা। এমনকি এই জগতের যিনি অধীশ্বর তাঁকেও বলা হয় জগৎ পিতা। কিন্তু এত পিতার ভিড়েও কেউ কখনো পরিসংখ্যানিক পিতা (statistical father) এই শব্দটি শুনেছেন কি?

যত রকম পিতাই থাকুক না কেন পিতা বলতে জন্মদাতা পিতাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। পিতা হবার আনন্দ, উত্তেজনা আর তৃপ্তি যে কতটা তা যারা বাবা না হয়েছেন তাদের বোঝানো বেশ কষ্টের। তবে এ মধুর তৃপ্তি বেদনায় পর্যবসিত হয়ে যায়, যখন সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ সংশয় জাগে পিতার মনে। হাল জামানায় ডিএনএ বা আরও অনেক পরীক্ষার মাধ্যমে পিতৃত্ব নিশ্চিত করা যায় কিন্তু অতীতে বিষয়টি এত সহজ ছিল না।

মূল ঘটনায় আসি। সময়কাল ১৯৪৬। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর হ্যাডলাম তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেবার অভিপ্রায়ে আদালতে এক মামলা ঠুকে দিলেন। হ্যাডলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে যাবার ৩৪৯ দিন পর তাঁর স্ত্রী একটি সন্তানের জন্ম দেন। সাধারণভাবে একটি সন্তান জন্মানোর সময়কাল ৯ মাস ১০ দিন অর্থাৎ ২৮০ দিন। সেক্ষেত্রে ৩৪৯ দিনের ব্যবধান মেজর হ্যাডলামের কাছে খুবই দীর্ঘ মনে হয় এবং তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে তিনি এই সন্তানের জনক নন।

দীর্ঘ শুনানি শেষে বিচারক অভিমত দেন যে ৩৪৯ দিনের ব্যাবধান দীর্ঘ হলেও অসম্ভব নয়। আর সে কারণে তিনি মেজর হ্যাডলামের আবেদনটি খারিজ করে দেন। এর কিছুদিন পর আরেকজন ব্রিটিশ মেজর একই রকম অভিযোগ নিয়ে দ্বারস্থ হন আরেকটি আদালতে। এক্ষেত্রে মেজর তার স্ত্রীকে ছেড়ে গিয়েছিলেন ৩৪০ দিন আগে। এক্ষেত্রে অবশ্য বিচারক সন্তান জন্মের জন্য ৩৪০ দিন অবিশ্বাস্যরকম দীর্ঘ বিবেচনায় মেজরকে অনুমতি দেন বিবাহ বিচ্ছেদের। আরেকটি মামলায় এক ব্যক্তি স্ত্রীকে ত্যাগ করার অনুমতি পান যেখানে ব্যবধান ছিল ৩৩১ দিনের।

বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, পরকীয়া, অবৈধ সন্তানের জন্ম এসব চটকদার ঘটনা সবসময়েই মিডিয়ার কাছে বাড়তি আকর্ষণ লাভ করে থাকে। ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পাতার বড় অংশ জুড়ে স্থান পেতে থাকে এসব ‘চাটনি’ খবর। সেই সাথে আরেকটি শব্দ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে- বহির্মান বা outlier। পরিসংখ্যানের পরিভাষায় একেবারেই অস্বাভাবিক মানের কোনো উপাত্তকে বলা হয় বহির্মান। সন্তান জন্ম দেবার সময় হিসেবে এই ৩৩১ দিন, ৩৪০ দিন, ৩৪৯ দিন বহির্মান কি না এই প্রশ্নগুলো উঠতে থাকে ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। আর এর মাধ্যমেই বহির্মান শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

জনান্তিকে বলে রাখি বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পি এইচ ডি গবেষণার মূল প্রতিপাদ্যই ছিল এই সব বহির্মান সনাক্তকরণ এবং এর প্রতিকার। আর সে কারণেই এই অধম রহমতউল্লাহ ইমন হ্যাডলাম মিঞা বিবি এবং অন্যান্য যুধ্যমান দম্পতিদের কাছে ঋণী।

আবার মূল গল্পে ফেরা যাক। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে। হাজার হাজার সৈন্য গিয়েছেন যুদ্ধে- তাদের অনেকের স্ত্রীই সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো বেশ দেরিতে। এই নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে সন্দেহ, অবিশ্বাস। মামলার পর মামলা আসছে আদালতে আর যেহেতু বিচারবোধ ছাড়া পিতৃত্ব নির্ধারণের কোনো স্বীকৃত পথ জানা নেই বিচারকেরাও দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক সাংঘর্ষিক রায়। আর এগুলো সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন আপিল আদালত।

এক মামলার রায় অন্য মামলায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৩৩১ দিন যদি সন্তান জন্ম দেবার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যবধান হয় তবে ৩৪৯ দিন স্বাভাবিক হয় কীভাবে? উপায়ন্তর না দেখে ব্রিটিশ কোর্ট অফ জাস্টিস শরণাপন্ন হলেন ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং রয়্যাল স্ট্যাটিসক্যাল সোসাইটির। পিতৃত্ব নির্ণয়ের একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি খুঁজে বের করতেই হবে।

শুরু হল দক্ষ যজ্ঞ। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং রয়্যাল স্ট্যাটিসক্যাল সোসাইটি সন্তানসম্ভবা ১৩,৬৩৪ জন মহিলাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের সন্তান জন্মের সময় নির্ধারণ করলেন। পরিসংখ্যানবিদদের জন্য বিশেষ সন্তোষের কারণ ছিল এই যে জন্মসময়গুলো একটি আয়তলেখ (histogram) এর মাধ্যমে উপস্থাপন করলে দেখা গেল এটি পরিমিত নিবেশন (normal distribution) এর রূপ নিয়েছে। আয়তলেখের ঠিক কেন্দ্রেই ছিল গড় মান ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিন। আর এ কথাও অনেকেরই জানা যে উপাত্ত যখন পরিমিত নিবেশনে বিন্যস্ত থাকে তখন গড় থেকে ৩ পরিমিত ব্যবধান (standard deviation) নিয়ে কোন সীমানা নির্ধারণ করলে তা উপাত্তের ৯৯.৭% অর্থাৎ প্রায় পুরোটাই ধারণ করে থাকে।

পরিমিত নিবেশন বা বেল কার্ভের চেহারা।

সন্তান জন্মের গড় সময়কালের সাথে ৩ পরিমিত ব্যবধান বিস্তার নিলে তা ৩৬০ দিন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। পরিসংখ্যানের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই হাউজ অফ লর্ডস ১৯৫১ সালে আইনজারি করে দিলেন যে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ৩৬০ দিনের মধ্যে যেসব শিশুর জন্ম হবে স্বামীকে সেই শিশুর পিতৃত্ব মেনে নিতে হবে। ডি এন এ পদ্ধতিতে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণের রীতি চালু হবার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণের আইনগত পন্থা। মনে যত দ্বিধা দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন সন্তানের পিতৃত্ব আপনাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। বাস্তবে যাই হোক না কেন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বনে যাওয়া এসব পিতাদের ক্ষেত্রে তখন এক বিশেষ অভিধা জুটেছিল- পরিসংখ্যানিক পিতা।

লেখকঃ অধ্যাপক, ম্যাথেম্যাটিক্যাল সায়েন্সেস, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি। 

আরও পড়ুনঃ
☛ বেল কার্ভের জাদু
Category: articles

Sunday, September 10, 2017

[লেখাটি ইতোপূর্বে বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের অক্টোবর, ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল]

আচ্ছা অনুমান করুন দেখি, বাংলাদেশে কত লোক ঘুষ খায়? আন্দাজে বলা কঠিন, তাই না?  কিন্তু ধরুন, আমরা জানতে চাই কোনো এলাকায় বা সরকারের কোনো বিভাগে প্রায় কত লোক ঘুষ খায় । আমরা যদি মানুষকে গিয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করি, 'আপনি ঘুষ খান কি না?', তাহলেতো আর সব সময় সঠিক উত্তর পাব না। কিন্তু পরিসংখ্যান আর সম্ভাবনা তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই মোটামুটি একটা হিসাব করে ফেলা যায়।

এ কৌশলের মাধ্যমে আমরা কত লোকের মধ্যে প্রায় কত লোক ঘুষ খায় তা জানতে পারব। অবশ্য ঠিক কারা কারা ঘুষ খায় তা জানতে পারব না।



আমরা কাজটি করব পরিসংখ্যানের সম্ভ্যাবনার ধারণা কাজে লাগিয়ে। প্রথমেই আমাদেরকে পরীক্ষা চালানোর জন্যে কিছু লোক বাছাই করতে হবে। এই সংখ্যা যত বেশি হবে ততই ভালো, অন্তত এক হাজার নিলেও মোটামুটি চলবে। এদেরকে আমরা বলব টার্গেট গ্রুপ। এখন সাথে রাখতে হবে একটি ভালো (Fair) কয়েন। কয়েনটিকে হতে হবে নিখুঁত, অর্থ্যাৎ একে এমন হতে হবে যেন টস করলে হেড ও টেইল ওঠার সম্ভাবনা সমান থাকে। এই কয়েন নিয়ে আমরা এক এক করে আমাদের টার্গেট গ্রুপের ব্যক্তিদের কাছে যেতে থাকব।

ধরুন, আমরা মিস্টার এক্স এর কাছে গেলাম। তার কাছে প্রশ্ন থাকবে তিনি ঘুষ খান কি না। কিন্তু তাকে বিব্রত করা যাবে না। তা কী করে সম্ভব? সেটাই বলছি।

তাকে কয়েনটি দিয়ে বলতে হবে,
আপনি কয়েনটি টস করবেন। টসের ফলাফল আমাদেরকে জানানো লাগবে না। যদি টসে হেড পড়ে, তাহলে প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলবেন। আর যদি টেইল দেখেন তবে সত্য কথা বলবেন।

এখানেই হল মূল ব্যাপার। মনে রাখতে হবে যে উত্তর হ্যাঁ হতে পারে দুটো কারণে। এক, তিনি টস করে হেড পেয়েছেন অথবা দুই, তিনি টস করে টেইল পেয়েছেন এবং সত্যি সত্যিই ঘুষ খান। অতএব তিনি কি টসে হেড পড়াতে হ্যাঁ বলেছেন নাকি (টসে টেইল পেয়ে এবং) আসলেই ঘুষ খান বলে হ্যাঁ বলেছেন সেটা আমরা জানব না। ফলে তিনি নিরাপদ, তার সম্মান হানি হচ্ছে না। এই কথাটি ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলতে হবে, নাহলে সৃষ্টি হবে বিব্রতকর পরিস্থিতির।

এই পরীক্ষা চালিয়ে আমরা অনেকগুলো হ্যাঁ ও না পেলাম। মনে করি, আমরা এক হাজার লোকের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে মোট ৮০০ উত্তর পেলাম হ্যাঁ। অর্থ্যাৎ ঘুষ খায় কি না এই প্রশ্নের উত্তরে ৮০০ জন হ্যাঁ বলেছে। মনে রাখতে হবে এর মানে কিন্তু এটা নয় যে ৮০০ লোক ঘুষ খায়। এই ৮০০ লোকের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা সত্যি সত্যি ঘুষ খায় বলে হ্যাঁ বলেছে, আর কিছু লোক হ্যাঁ বলেছে কয়েনে হেড পড়তে দেখে।

তাহলে আমরা কীভাবে জানব কত লোক আসলেই ঘুষ খায়?

মনে করে দেখুন, আমরা পরীক্ষা চালিয়েছিলাম নিখুঁত কয়েন দিয়ে। এতে হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা ছিল সমান। এখন ১০০০ লোক নিয়ে পরীক্ষা চালানোর অর্থ হল ১০০০ বার কয়েন টস হবে। হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা সমান থাকার কারণে আমরা ধরে নিতে পারি যে এক হাজার টসের মধ্যে প্রায় ৫০০ টি হেড পড়েছিল। ফলে ৮০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৫০০ লোক এমন থাকবে যারা হ্যাঁ বলেছে টসে হেড পড়ার কারণে। এরা আসলে ঘুষ খায় কি না তা আমরা জানব না। কিন্তু বাকি ৩০০ টি হ্যাঁ বলা লোক হ্যাঁ বলেছে এ জন্যেই যে তারা আসলেই ঘুষ খায়। কারণ আমরা বলেছি টেইল পড়লে যাতে উনি সত্য কথা বলেন।

কয়েন নিখুঁত হবার কারণে টেইলও পড়বে প্রায় ৫০০ বার। এখন টেইল পড়ার পরও হ্যাঁ বলার অর্থ হল, এরা আসলেই ঘুষ খায়। তার মানে আমরা পেলাম, প্রতি ৫০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৩০০ লোক ঘুষ খায়।
মজার ব্যাপার, তাই না?

কিছু বিষয় মাখায় রাখতে হবে:
১. টার্গেট গ্রুপকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে উনি ঘুষ খান কি না তা আমরা জানব না। উনি নিশ্চিন্তে উত্তর দিতে পারেন।
২. কয়েন নিখুঁত হলেও ঠিক অর্ধেক পরিমাণে হেড ও টেইল পড়বে না, দুটোর পরিমাণই হবে অর্ধেকের কাছাকাছি। ফলে আমরা যত বেশি মানুষ নিয়ে টেস্ট করব, ভুলের পরিমাণ তত কমবে।
৩. এই কৌশল খাটিয়ে একই রকম অন্য পরীক্ষাও চালাতে সম্ভব। যেমন কেউ ধূমপান করেন কি না বা অ্যালকোহল সেবন করেন কি না, বা আয়কর ফাঁকি দেন কি না ইত্যাদি।
৪. এখানে আমাদেরকে আরও ধরে নিতে হচ্ছে, মানুষ সত্য কথা বলবে। বাস্তবে যারা ঘুষ খাওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করতে পারে, তারা মিথ্যাও বলতে পারে। তবে যেহেতু ঘুষ খাওয়ার তথ্য ফাঁস হচ্ছে না, তাই আশা করা যায়, আমরা সত্যিটাই শুনব।

তথ্যসূত্রঃ 
এই পদ্ধতির উদ্ভাবক হলেন পরিসংখ্যানবিদ শেলডন রস। 

কৃতজ্ঞতায়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক স্যার ড. জাফর আহমেদ খান (বিষয়টি সহজ করে উপস্থাপন করার জন্যে স্যারকে ধন্যবাদ) 
Category: articles

Saturday, September 9, 2017

[লেখাটি ইতোপূর্বে পাই জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল] 

পরিসংখ্যানের বিভিন্ন ধাঁধা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অনেক সময় মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। মন্টি হল প্যারাডক্স নিয়ে চিন্তা করতে গেলেই চক্করটা একটু বেশি-ই হয়ে যায়। শত শত পিএইচডি ধারী পরিসংখ্যানবিদও এর বক্তব্য শুরুতে মেনে নিতে চান না।

সমস্যাটি কী, দেখা যাক।

মনে করুন, আপনি একটি গেম শোতে আছেন। আপনার সামনে আছে তিনটি দরজা। একটি দরজার পেছনে আছে একটি গাড়ি, অপর দুই দরজার পেছনে আছে দুটি ছাগল। আপনি একটি দরজা বাছাই করলেন। ধরুন সেটি ১ নং  দরজা। এখনও কিন্তু খুলেননি। খোলার আগে হোস্ট আপনাকে আরেকটা দরজা খুলে দেখাল। ধরুন সেটা ৩ নং। সে আগে থেকেই জানত, কোন দরজার পেছনে কী আছে। ৩ নং দরজা খুলে দেখা গেল, এতে ছাগল আছে। এখন সে প্রস্তাব দিল, 'আপনি কি ১ এর বদলে ২ নং দরজা বাছাই করতে চান?' এখন সিদ্ধান্ত পাল্টালে কি আপনার লাভ হবার সম্ভবানা আছে?


অর্থ্যাৎ ১ এর বদলে ২ নং দরজা বেছে নিলে গাড়ি পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে কিনা?

Parade ম্যাগাজিনের আস্ক মেরিলিন পাতায় কলামিস্ট মেরিলিনকে এক পাঠক প্রশ্নটি করেন। মেরিলনের উত্তর ছিল গাড়ি পাবার সম্ভাবনা বাড়াতে হলে অবশ্যই অপশন বদল করা উচিত। কারণ, অপশন বদল করলে গাড়ি জেতার সম্ভাবনা হবে $\frac{২}{৩}$, আর না করলে $\frac{১}{৩}$।
কিন্তু কথটা ঐ কলামের অধিকাংশ পাঠক মেনে নিতে পারলেন না। কেন অপশন বদল করলে লাভ হবে? সমস্যাটি প্যারেড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবার পর প্রায় ১০,০০০ লোক এর বিপক্ষে মত দিলেন। এদের প্রায় ১০০০ জন আবার ছিলেন পিএইচডিধারী!

আসলে প্যারাডক্সটি স্বাভাবিক বুদ্ধির একেবারেই বিপরীত। ভাবলে মনে হয়, যে কোন একটা দরজা নিলেই হল। একটি দরজার পেছনে ছাগল দেখার পরে বাকি দুটো দরজার যে-কোনোটির পেছনে গাড়ি থাকতে পারে। তার মানে যে কোনোটির পেছনে গাড়ি থাকার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি, মানে $\frac{১}{২}$ করে।

গেম শো-টির আনুষ্ঠানিক শর্তগুলো এ রকমঃ
১. হোস্টকে অবশ্যই এমন কোন দরজা খুলবে, যা প্রতিযোগী বাছাই করেনি।
২. হোস্ট এমন দরজা খুলবে যার পেছনে ছাগল থাকবে, গাড়ি নয়।
৩. হোস্টকে অবশ্যই অপশন বদল করার অফার দিতে হবে।

কিন্তু পরিবর্তনে কীভাবে লাভ হয় আসলে?

সরল সমাধানঃ

প্রতিযোগীর উদ্দেশ্য হল গাড়ি জেতা। এখন জিনিস আছে মোট তিনটি- দুইটি ছাগল ও একটি গাড়ি। তাহলে দৈব চয়নে একটি দরজা খুললে গাড়ি জেতার সম্ভাবনা $\frac{১}{৩}$ এবং ছাগল জেতার সম্ভাবনা $\frac{২}{৩}$। অর্থাৎ অনুমানের উপর ভিত্তি করে একটি দরজা খুললে ছাগল জেতার সম্ভাবনা বেশি। এখন তাকে একটি দরজা খুলে দেখানো হল তাতে একটি ছাগল আছে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগের দরজাই খুলবে নাকি সিদ্ধান্ত বদলে অন্য দরজা খুলবে।

এবার মনে করুন, প্রতিযোগী প্রথমে ছাগল বেছেছিল। তাহলে বদল করলেই সে গাড়ি পেয়ে যাচ্ছে, কারণ খোলা দরজায় ছাগল দেখা যাচ্ছে।

অপরদিকে সে যদি প্রথমেই গাড়ি বাছাই করে থাকতো তবে বদল করলে সে পেত ছাগল। তার মানে, প্রথমে ছাগল বাছাই করলে লাভ হয় বেশি। সেক্ষেত্রে বদল করলেই গাড়ি! এখন ছাগল যেহেতু দুইটি, তাই প্রথমে ছাগল বাছাই হবার সম্ভাবনা বেশি। তার মানে বদল করলেই গাড়ি পাবার সম্ভাবনা বেশি! আশা করি স্পষ্ট হয়েছে।

মেরিলনের সমাধানঃ
প্যারেড ম্যাগাজিনে মেরিলিন ভস স্যাভান্ট একটি সারণির মাধ্যমে চিত্রটি তুলে ধরে খুবই সহজ ভাষায় সমাধান দিয়েছিলেন। একটি গাড়ি ও দুইটি ছাগল তিনটি দরজার পেছনে তিনভাবে বিন্যস্ত থাকতে পারে। মনে করুন, প্রতিযোগী প্রথমে ১ নং বাছাই করলনে। এবার দেখি, অপশন পাল্টালে আর না পাল্টালে কেমন রেজাল্ট হয়।


দেখা যাচ্ছে, আমাদের চূড়ান্ত অপশন ৩ টি। এর মধ্যে অপশন পাল্টালে গাড়ি, আর না পাল্টালে ছাগল পাবার সম্ভাবনা বেশি-যথাক্রমে ২ টি করে।
আরেকটি সহজ সমাধান দেখি ডায়াগ্রামের মাধ্যমে।


মন্টি হল সমস্যার সমাধান 

আমেরিকান টেলিভিশন অনুষ্ঠান লেটস মেইক আ ডিল নির্ভর এই প্যারাডক্সটির নাম দেওয়া হয় ঐ অনুষ্ঠানের প্রথম হোস্ট মন্টি হলের নামে। জীব-পরিসংখ্যানবিদ স্টিভ সেলভিন প্রথম আমেরিকান জার্নাল দ্য আমেরিকান স্ট্যাটিসটিক্সে সমস্যাটি পাঠান।

সূত্রঃ
[১] mathworld.wolfram.com/MontyHallProblem.html
[২]  en.wikipedia.org/wiki/Monty_Hall_problem
Category: articles

Sunday, December 4, 2016

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ ঘটনার পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে একটি মজার ব্যাপার চোখে পড়বে। যেমন আপনি যদি কোনো ক্লাসের ছাত্রদের প্রাপ্ত নম্বরের দিকে খেয়াল করেন, তবে দেখা যাবে অনেক বেশি মার্ক পেয়েছে এমন ছাত্রের সংখ্যা খুব কম। আবার খুব কম মার্ক পেয়েছে এমন ছাত্রের সংখ্যাও খুব কম। তবে মোটামুটি মার্ক পাওয়া ছাত্রদের সংখ্যা অনেক বেশি। কোনো একটি পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া এমন চিত্রকে গ্রাফের মাধ্যমে তুলে ধরলে যে অকৃতি পাওয়া যায় তার নামই বেল কার্ভ (bell curve)।

বেল কার্ভ

পরিসংখ্যানের পরিভাষায় নাম পরিমিত বিন্যাস (normal distribution)। আকৃতি বেল বা ঘণ্টার মতো বলেই এর এমন নাম হয়েছে। তবে পরিসংখ্যানের দৃষ্টিতে আসলে এটি একটি সম্ভাবনা বিন্যাস (probability distribution) ।

পরিসংখ্যানে এরকম অনেকগুলো সম্ভাবনা বিন্যাস রয়েছে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে কারিশমা দেখাতে সক্ষম এই বেল কার্ভ। এমনকি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্যান্য কিছু কিছু বিন্যাসও আচরণ করে এর মতো। এই বেল কার্ভের জাদু দেখানোর অন্যতম একটি হাতিয়ার হল ৬৮-৯৫-৯৯ নিয়ম। এই নিয়মের জাদু দেখার আগে একটু জানা দরকার পরিমিত ব্যবধান (standard deviation) কাকে বলে।

মনে করুন, আপনার কাছে একটি নমুনা (sample) আছে, যাতে একটি ক্লাসের ৫ জন ছাত্রের প্রাপ্ত নম্বর দেখা যাচ্ছে। ধরুন নম্বরগুলো হল (২০ এর মধ্যে) ১৪, ১৫, ১৩, ১৪, ১৫। ধরুন, আরেকবার একটি নমুনা নিয়ে পাওয়া নম্বরগুলো হল ৯, ১৬, ১৯, ৭, ১৪। প্রথম নমুনায় নম্বরগুলো খুব কাছাকাছি। এদের গড় হল ১৪.২। নম্বরগুলো গড়ের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। এক্ষেত্রে আমরা বলব এদের পরিমিত ব্যবধান কম।

পরের নমুনার নম্বরগুলো অনেক বেশি ছড়িয়ে আছে। এদের গড় হল ১৩। এ নম্বরগুলো গড় থেকে অনেক বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অতএব এদের পরিমিতি ব্যবধান বেশি। তার মানে যে উপাত্ত যত বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তার পরিমিতি ব্যবধান তত বেশি।

ধরুন, উপরের প্রথম নমুনার যে মূল উপাত্ত থেকে পাওয়া গেছে পরিমিত ব্যবধান ১। আমরা আগেইে দেখেছি এদের গড় ১৪.২। এখন গড় থেকে ১ যোগ ও বিয়োগ করে পাই (১৩.২, ১৫.২)। 

৬৮-৯৫-৯৯ নিয়ম বলছে যে এই উপাত্তের প্রায় ৬৮ শতাংশ ছাত্রের নম্বর ১৩.২ থেকে ১৫.২ এর মধ্যে থাকবে। একইভাবে ২ (পরিমিত ব্যবধান) যোগ- বিয়োগ করে আমরা বলতে পারব, প্রায় ৯৫ শতাংশ ছাত্রের নম্বর থাকবে ১২. ২ থেকে ১৬.২ এর মধ্যে। পরিমিত ব্যবধান ৩ হলে আমরা বলতে পারব, প্রায় ৯৯ শতাংশ ছাত্রের নম্বর থাকবে ১১.২ থেকে ১৭.২ এর মধ্যে।

বেল কার্ভের নিয়ম। $\mu$ হলো গড়, আর $\sigma$ হলো পরিমিত ব্যবধান। 

আমাদের ধরে নেওয়া নমুনা ছোট্ট ছিল বলে এই ফলাফলকে গুরুত্বহীনও মনে হতে পারে। কিন্তু ধরুন আপনার কাছে আছে দশ হাজার ছাত্রের নম্বর, যেখানে গড় হলো ৭৫ ও পরিমিতি ব্যবধান ২। তাহলে নম্বরগুলো ঠিক কত ছিল তা না জেনেও আপনি বলতে পারবেন, প্রায় ৬৮ শতাংশ ছাত্র নম্বর পেয়েছে ৭৪ থেকে ৭৬ এর মধ্যে। একইভাবে প্রায় ৯৫ শতাংশ ছাত্র নস্বর পেয়েছে ৭৩ থেকে ৭৭ এর মধ্যে। আর প্রায় ৯৯ শতাংশ ছাত্রই নম্বর পেয়েছে ৭২ থেকে ৭৮ এর মধ্যে। 

দারুণ, তাই না!

শুধু গড় দেখে আপনি যদি বলে ফেলতেন যে ছাত্রদের ফলাফল খুব ভালো, কী ভুলটাই না করতেন! দেখুন ৯৯ শতাংশের মধ্যেও কেউ ৮০ পায়নি। দেশের শিক্ষা নীতি প্রনয়ণে কি কাজেই না আসবে এই পরিমিত বিন্যাস! শুধু কি তাই? পরিমিত বিন্যাস মেনে চলে এমন যে কোনো উপাত্ত থেকেই আপনি দারুণ সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাহলে চলুন দেখে নিই আর কোন ধরনের উপাত্ত মেনে চলে এই জাদুর বিন্যাসটি।

মনে করুন আপনি একজন প্রকৌশলী। একটি শিল্প- কারখানায় প্রস্তুতকৃত বল্টুর দৈর্ঘ্য ঠিক আছে কি না জানতে চান। সেখানে বল্টুর একটি বড় সড় নমুনা নিয়ে গড় ও পরিমিত ব্যবধান দিয়ে হিসাব করে দেখবেন কত শতাংশ বল্টু আপনার নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যে আছে। এটা করা যাবে কারণ বিভিন্ন পরিমাপের উপাত্ত মেনে চলে পরিমিত বিন্যাস।

একইভাবে মানুষের উচ্চতা, বয়স, ওজোন ইত্যাদি মেনে চলে এই বিন্যাস। পদার্থবিদ্যার জগতেও বেল কার্ভ সরবে নাক গলায়। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দেখান যে এক ধরনের দোলকের সম্ভাবনা ফাংশন এবং ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কণার অবস্থান বের করা যায় বেল কার্ভ দিয়ে। জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন টিস্যুর দৈর্ঘ্য, উচ্চতা, ক্ষেত্রফল ও ওজোন মেনে চলে পরিমিত বিন্যাস। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীর চুল, নখ, দাঁত ও নখরের দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রেও বলা চলে একই কথা। এমনকি মানুষের রক্ত চাপসহ বিভিন্ন শারীরিক পরিমাপ মেনে চলে এই বিন্যাস। কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পরিমাপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বার যে ভুলগুলো হবে তাও মেনে চলে বেল কার্ভ। আসলে এর প্রয়োগ বলে শেষ করা সম্ভব নয়।

এর আরও কয়েকটি দারুণ বৈশিষ্ট্য আছে।

১। এটি একটি প্রতিসম বিন্যাস। ফলে অর্ধেক মান থাকবে গড়ের ওপরে এবং অর্ধেক নিচে। আবার গড় থেকে ১ বা ২ পরিমিত ব্যবধানের ওপরে যে পরিমাণ উপাত্ত থাকবে, তার নিচেরে দিকেও প্রায় সমান পরিমাণ উপাত্ত থাকবে। পরিসংখ্যানের কাজই হল অনিশ্চিত অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা। এই কাজে বেল কার্ভের এই ধর্মও বেশ কাজে আসে।

২। কোনো উপাত্ত যদি বেল কার্ভের মতো বিন্যাস মেনে না চলে তবে অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আপনি যে কোনো বিন্যাসের উপাত্তগুলো গড় নিন। নমুনার সাইজ যদি বড় হয় তবে দেখা যাবে এই গড়গুলো ঠিকই বেল কার্ভের মতো হচ্ছে। ফলে অনিশ্চিত অবস্থায়ও মেঘ কেটে যাচ্ছে।

৩। এছাড়াও নমুনা বড় হলে অনেক বিন্যাসই সরাসরি বেল কার্ভের মতো হয়ে যায়। গড় নিতে হয় না।

বেল কার্ভের ইতিহাস:

কেউ কেউ বেল কার্ভের আবিষ্কারের জন্যে ডি ময়ভারকে কৃতিত্ব দেন। ডি ময়ভার ১৭৩৮ সালে যে কথাগুলো প্রকাশ করেছিলেন তাতে অস্পষ্টভাবে পরিমিত বিন্যাসের কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি তাঁর নিজেরই সম্ভাবনার বিন্যাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ১৮০৯ সালে কার্ল ফ্রেডরিখ গাউস পরিসংখ্যানের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রকাশ করেন। এতে ছিল পরিমিত বিন্যাসের কথাও। আর তাই বেল কার্ভ বা পরিমিত বিন্যাসের অপর নাম গাউসিয়ান বিন্যাস।

তাঁর পরে বিন্যাসটিতে বড় অবদান রাখেন পিয়েরে ল্যাপ্লাস। অন্যান্য অবদানের মধ্যে তিনি প্রমাণ করেন যে নমুনার সাইজ বড় হলে যে কোনো সম্ভাবনা বিন্যাসের গড় বেল কার্ভের মতো হবে। এই সূত্রকে বলা হয় কেন্দ্রীয় সীমা উপপাদ্য (Central limit theorem)।

এছাড়াও এতে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছিলেন ম্যাক্সওয়েল, অ্যাবে ও অ্যাড্রেইন। এমনকি গ্যালিলিও ও এতে খানিকটা অবদান রাখেন। যদিও সে সময় বেল কার্ভের ধারণার প্রচলন ঘটেনি। তিনি দেখিয়েছিলেন যে কোনো পরিমাপের ভুলগুলোর পরিমাণ বেল কার্ভের মতো দেখায়।

নোট:
পরিমিত ব্যবধানকে সাধারণত গ্রিক বর্ণ σ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। তবে নমুনা থেকে বের করলে σ এর বদলে ল্যাটিন বর্ণ s লেখা হয়। এর সূত্র হল:

$$\sigma = \sqrt{\frac{\sum_{i=1}^N(x_i-\mu)^2}{N}}$$

যেখানে, $\mu$ হলো গড়। N হলো মোট কয়টি মানের সংখ্যা।

সূত্র:
১। অ্যাবাউট ডট কম
২। উইকিপিডিয়া
Category: articles

Saturday, September 10, 2016

ঋণাত্মক সম্ভাবনা!

গণিত ও পরিসংখ্যান সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন-এমন অধিকাংশ মানুষই কথাটি শুনলে চোখ কপালে তুলে ফেলবেন। ভেংচি কাটবেন। বক্তার মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কারণ তারা জানেন, সম্ভাবনা (Probability) কোনো ঘটনা ঘটার আনুকূল্য প্রকাশ করে। যেমন, কারো কাছে ১০ টি বল আছে। ৫টি বল লাল হলে না দেখে একটি বল তুললে সেটি লাল হবার সম্ভাবনা $\frac{৫}{১০}$। একটিও লাল না হলে লাল বল পাওয়ার সম্ভাবনা $\frac{০}{১০}$ বা শূন্য। সবগুলো লাল হলে সম্ভাবনা হবে $\frac{১০}{১০}$, মানে এক।

অতএব, প্রচলিত ধারণা অনুসারে সম্ভাবনার মান হতে পারে ০ থেকে ১ পর্যন্ত। ০ হলে বোঝা যাবে, ঘটনাটি একেবারেই ঘটবে না। আর ১ হওয়ার মানে, সেটি ঘটবেই। নিশ্চিত। তাহলে সম্ভাবনা আবার ঋণাত্মক হয় কী করে? প্রথাবিরোধী ও অযোৗক্তি চিন্তা!


গণিতের ইতিহাসে কিন্তু এমন বিপরীত চিন্তার প্রাচুর্য লক্ষণীয়। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক গণিতবিদ ডায়াফ্যান্টাস বলেছিলেন, 4x + 20 = 0 সমীকরণের যে ঋণাত্মক সমাধান আসে সেটি অযৌক্তিক। ১৭০০ সালেও ইউরোপে ঋণাত্মক সংখ্যাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো। তবে চীন ও ভারতে খ্রিস্টের জন্মের কয়েক শতকের মধ্যেই ঋণাত্মক সংখ্যার প্রচলন ঘটেছিল। ভারতীয়দের সাথে সম্পর্কের সুবাদে ইসলামী আমলের গণিতবিদরাও এর সাথে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু শূন্যের মতোই ঋণাত্মক সংখ্যাও ইউরোপে সাধুবাধ পায় অনেক পরে।
এমনকি ১৭৫৯ সালে ইংরেজ গণিতবিদ ফ্র্যান্সিস ম্যাসারস বলেছিলেন,
ঋণাত্মক সংখ্যা একটি সমীকরণের চেহারাকেই কলুষিত করে দেয়। এগুলো একবারেই অর্থহীন।
আঠারো শতকেও সমীকরণের ঋণাত্মক সমাধানকে হিসাবের বাইরে ফেলে দেওয়া হতো। অয়লারের মতো গণিতবিদও এদেরকে অর্থহীন মনে করতেন। শেষ পর্যন্ত লিবনিজ সাহেব এই সংখ্যাদেরকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করা শুরু করেন।

৪ থেকে ৩ বিয়োগ দিলে ১ হয়। জানি। কিন্তু ৩ থেকে ৪ বিয়োগ দিলে? এর অর্থ তো এমন যে, আমার কাছে তিনটি গরু আছে। সেখান থেকে চারটি গরু আমি কাউকে দিয়ে দিলাম। এটা কীভাবে সম্ভব? ধরুন আমার কাছে ৫০ টাকা আছে। এখান থেকে কি আমি কাউকে ১০০ টাকা দান করতে পারি? হ্যাঁ। তার জন্যে আমাকে প্রথমে ৫০ টাকা ধার করতে হবে। তার মানে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা কাউকে দিয়ে দিলে আমার কাছে মাইনাস ৫০ টাকা থাকবে। মানে আমি ৫০ টাকা দেনা থাকব। এভাবেই ঋণাত্মক সংখ্যা বাস্তব হিসাব-নিকাশের অনিবার্য অংশ হয়ে যায়। সহজ করে দেয় গণিতের কাজ।

ঋণাত্মক সংখ্যার মতোই বাধার সম্মুখীন হয়েছিল ভগ্নাংশ ও ’কাল্পনিক’ সংখ্যাও। বর্তমানে এগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত গাণিতক সংখ্যা। কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামের পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাগটির শুরুতেই দেখা যায় 'কাল্পনিক' সংখ্যার পদচারণা।

একইভাবে সমূহ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে ঋণাত্মক সম্ভাবনা নিয়েও। ১৯৪২ সালে নোবেল বিজয়ী তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল ডিরাক একটি পেপার প্রকাশ করেন। এতে তুলে ধরেন ঋণাত্মক সম্ভাবনার কথা। তিনি বলেন,
ঋণাত্মক সম্ভাবনাকে উদ্ভট ভাবা ঠিক নয়। 
১৯৮৭ সালে নোবেলজয়ী আরেক পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানও এ বিষয়ে একটি পেপার প্রকাশ করেন। তিনি এখানে দেখান, ঋণাত্মক সম্ভাবনার চিন্তা মোটেও আজগুবি নয়। এই ধারণা বরং প্রয়োগ করা যায় পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো ক্ষেত্রে।

তাঁর মতে হিসাবের সুবিদার্থে আমরা যেভাবে ঋণাত্মক সংখ্যার ব্যবহার করি, সেই একক যুক্তিতে ব্যবহার করা চলে ঋণাত্মক সম্ভাবনাও। ধরুন, কারো কাছে ১০টি আপেল আছে। এখান থেকে তিনি ১০টি কাউকে দিলেন, আর ৮টি নিলেন কারো কাছ থেকে। ঋণাত্মক সংখ্যা দিয়ে একে সহজেই হিসাব করা যায়। ৫-১০ = -৫ এবং -৫+৮ = ৩। শেষ পর্যন্ত সন্তোষজনকভাবে ধনাত্মক সংখ্যাই পাওয়া গেল। যদিও মাঝখানে ব্যবহার করা হয়েছে 'অযৌক্তিক' ঋণাত্মক সংখ্যা।

এবার মনে করুন, তিনটি তল বিশিষ্ট একটি গুটিতে যথাক্রমে ১,২ ও ৩ লেখা আছে। আরও ধরুন, গুটিগুলোকে দুইটি ভিন্ন শর্ত মেনে নিক্ষেপ করা যাবে। শর্ত A ও শর্ত B। শর্ত দুটির ক্ষেত্রে সম্ভাবনার মান হবে আলাদা। ধরুন, শর্ত A-এর ক্ষেত্রে ১ পড়ার সম্ভাবনা $P_{1A}$ = ০.৩, ২ পড়ার সম্ভাবনা $P_{2A}$= ০.৬ এবং ৩ পড়ার সম্ভাবনা  $P_{3A}$ = ০.১। শর্ত B-এর ক্ষেত্রে সম্ভাবনাগুলো যথাক্রমে $P_{1B}$ =০.১, $P_{2B}$= ০.৪ ও $P_{3B}$ = ০.৫। তার মানে, বিষয়টা এ রকম:

অবস্থা শর্ত A শর্ত B
০১ ০.৩ ০.১
০২ ০.৬ ০.৪
০৩ ০.১ ০.৫
মোট

এবার ধরুন গুটিটিকে মোট ১০ বার নিক্ষেপ করা হলো। ৭ বার নিক্ষেপ করা হলো শর্ত A অনুসারে। বাকি ৩ বার শর্ত B অনুসারে। তার মানে A-এর সম্ভাবনা P$_A$= ০.৭ ও B-এর সম্ভাবনা P$_B$= ০.৩। মনে রাখতে হবে, একটি সিস্টেমের সবগুলো ঘটনা ঘটার মোট সম্ভাবনা এক (১) হবে। এখন গুটি নিক্ষেপ করে সম্ভাবনার তত্ত্ব অনুসারে ১ পাওয়ার সম্ভাবনা হবে ০.৭ × ০.৩ + ০.৩ ×০.১ =০.২৪।

তার মানে, a যদি শর্ত হয়, আর P$_{ia}$ যদি হয় শর্তাধীন সম্ভাবনা, তাহলে a শর্তের জন্যে i এর সম্ভাবনা হবে
P$_i$ = $\sum_aP_{ia}.P_a$
এখানে P$_a$ হলো a শর্ত পূরণ হবার সম্ভাবনা। P$_{ia}$ মানে হলো i ও a ঘটার যৌথ সম্ভাবনা। বুঝতে অসুবিধা হলে টেবিল থেকে মিলিয়ে নিন। যেহেতু প্রতিটি শর্তের জন্যে কিছু না কিছু ঘটবেই, তাই $\sum_iP_{ia}$ =1 হবে।
যদি কোনো একটি শর্ত অবশ্যই পূরণ হয়, তাহলে যদি $\sum_aP_a$---(১)
হয় তাহলে $\sum_iP_i$ হবে।

(১) অনুসারে, আমরা কোনো না কোনো ফলাফল পাবই।

এবার ধরুন, কিছু শর্তাধীন সম্ভাবনা ঋণাত্মক হলো। ঋণাত্মক সংখ্যার মতোই ফাইনাল ফলকে অযৌক্তিক না বানিয়ে আমরা মাঝখানে এর ব্যবহার করতে পারি কি না দেখা যাক। এবার টেবিলটা এ রকমঃ
অবস্থাশর্ত Aশর্ত B
০১০.৩-০.৪
০২০.৬১.২
০৩০.১০.২
মোট

টেবিলটা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে (১) অনুসারে $P_{1B}$+ $P_{2B}$+ $P_{3B}$=1  হয়। এবার তাহলে ১ পাওয়ার সম্ভাবনা হবে $P_1$ = ০.৭×০.৩+০.৩× (-০.৪) =০.৯। স্বাভাবিক ফল। $P_{2B}$ ও ১ এর বেশি (১.২) হয়েছে। এ ধারণার সাথে ঋণাত্মক সম্ভাবনার কোনো পার্থক্য নেই। এটি হলো ঘটনাটি না ঘটার ঋণাত্মক সম্ভাবনা।

একইভাবে হিসাব করে ২ ঘটার সম্ভাবনা পাওয়া যাবে $P_2$=০.৭×০.৬+০.৩×১.২ =০.৭৮।

৩ ঘটার সম্ভাবনা হবে $P_3$=০.১৩। এদের যোগফল হয় ১, যা স্বাভাবিক ফল। আবার শর্তগুলোর নিজেদের অথবা ১, ২ বা ৩ ঘটার সম্ভাবনাও ঋণাত্মক হতে পারে। তবুও ফাইনাল রেজাল্ট যৌক্তিক হওয়া সম্ভব।

তাহলে ঋণাত্মক সম্ভাবনাকে আমরা ফাইনাল রেজাল্টের জন্যে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে না নিলেও অন্তত হিসাবের সুবিদার্থে মাঝখানে ব্যবহার করতেই পারি। এতে সম্ভাবনা তত্ত্বের কোনো বিধানের বিরুদ্ধে যাওয়া হয় না। ফাইনম্যান তাঁর পেপারে ঋণাত্মক সম্ভাবনার কিছু ব্যবহারিক উদাহরণও দেখিয়েছিলেন।

ইদানিং এ বিষয়ে নিয়মিত পেপার আসছে। মার্ক বারগিন ২০১০ সালে এক পেপারে এর প্রয়োগ দেখাতে গিয়ে একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন। মনে করুন, আমি কোনো বানান ভুল করি না। তাহলে এ লেখায় 'কারন' ('কারণ' এর স্থলে) শব্দটি থাকার সম্ভাবনা কত? প্রচলিত সম্ভাবনা সূত্র অনুসারে উত্তর হবে ০। কিন্তু অনেক সময় টাইপিং-এ ভুল হয়। অতএব আমরা বলতে পারি, লেখায় 'কারন' শব্দটি থাকার সম্ভাবনা হবে (-০.১)। পরে এটি ঠিক করা হলে আর কোনো ভুল বানান থাকবে না। অর্থাৎ, বলা যায়, টাইপিং ভুলের আগে সম্ভাবনা ঋণাত্মক ছিল। সব ভুল দূর করার পরে সম্ভাবনা শূন্য হলো।

১৯৩২ সালে আরেক নোবেল বিজয়ী ইউজিন উইগনারও ঋণাত্মক সম্ভাবনার দেখা পান। ১৯৪৫ সালে ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ  মরিস বার্টলেট দেখান, ঋণাত্মক সম্ভাবনার মধ্যে কোনো গাণিতিক বা যৌক্তিক অসঙ্গতি নেই। ২০১০ সালে এস্পেন হউগ দেখান যে গাণিতকি অর্থনীতিতেও এই ধারণা কাজে লাগানো সম্ভব।

সূত্রঃ
1. http://cds.cern.ch/record/154856/files/pre-27827.pdf
2. https://betterexplained.com/articles/a-visual-intuitive-guide-to-imaginary-numbers/
3. https://en.wikipedia.org/wiki/Negative_number#First_usage_of_negative_numbers

Category: articles